খাদ্য ও পুষ্টি
খাদ্য উপাদান
খাদ্য অনেকগুলো রাসায়নিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এ রাসায়নিক উপাদানগুলোকে খাদ্য উপাদান বলা হয়কেবলমাত্র একটি উপাদান দিয়ে গঠিত এমন খাদ্যবস্তুর সংখ্যা খুবই কম। এভাবে উপাদান অনুযায়ী খাদ্যবস্তুকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
১. আমিষ বা প্রোটিন – ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন ও দেহ গঠন করে।
২. শর্করা বা শ্বেতসার – শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে।
৩. স্নেহ বা চর্বি – তাপ ও শক্তি উৎপাদন করে।
এছাড়া তিন প্রকার অন্যান্য উপাদান বিশেষ প্রয়োজন। যথা-
১. খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন – রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়, বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উদ্দীপনা যোগায়।
২. খনিজ লবণ – বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।
৩. পানি – দেহে পানির সমতা রক্ষা করে, কোষের গুণাবলি নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষ অঙ্গাণুসমূহকে ধারণ ওতাপের সমতা রক্ষা করে।
শর্করা/শ্বেতসার
আমরা নাস্তায় রুটি, মুড়ি, চিড়া, পাঁউরুটি ইত্যাদি খাই। এগুলো শর্করা জাতীয় খাদ্য। শর্করা শক্তি উৎপাদনকারী খাদ্য।আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানগুলোর মধ্যে শর্করার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। শর্করা সহজপাচ্য। সবশর্করাই কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এই তিনটি মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। শর্করা দেহের কর্মক্ষমতাযোগায়। গ্লুকোজ এক ধরনের সরল শর্করা। রাসায়নিক গঠনপদ্ধতি অনুসারে সব শর্করাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। একটি মাত্র শর্করা দিয়ে গঠিত হয় মনোস্যাকারাইড। একে মৌলিক শর্করাওবলে। দ্বি-শর্করী ও বহু শর্করী পরিপাকের মাধ্যমে সরল শর্করায় পরিণতহয়ে দেহের শোষণযোগ্য হয়। মানবদেহ পরিপুষ্টির জন্য সরল শর্করাঅত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানবদেহ শুধুমাত্র সরল শর্করা গ্রহণ করতেপারে। গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, গ্যালাকটোজ এ তিনটি শর্করার মধ্যে গ্লুকোজরক্তের মাধ্যমে সারা দেহে পরিবাহিত হয়।
শর্করা, স্নেহ ও আমিষের মধ্যে শর্করা সর্বাপেক্ষা সহজপাচ্য। দেহে শোষিত হওয়ার পর শর্করা খুব কম সময়ে তাপউৎপন্ন করে দেহে শক্তি যোগায়। এর প্রম ও প্রধান কাজ হলো শক্তি উৎপাদন করা। ১ গ্রাম শর্করা ৪ কিলোক্যালরি তাপ উৎপন্ন করে। মানবদেহে প্রায় ৩০০-৪০০ গ্রাম শর্করা জমা থাকতে পারে। এ পরিমাণ শর্করা ১২০০-১৬০কিলোক্যালরি তাপ উৎপন্ন করে দেহের শক্তি যোগায়। বয়স, দেহের ওজন, উচ্চতা, পরিশ্রমের মাত্রার উপর শর্করার চাহিদা নির্ভর করে। একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষের শর্করা দৈনিক চাহিদা তার দেহের প্রতি কিলোগ্রাম ওজনের ৪.৬ গ্রাম হয়ে থাকে। একজন ৬০ কেজি ওজনের পুরুষ মানুষেরগড়ে প্রতিদিন শর্করার দৈনিক চাহিদা = (৬০X ৪.৬) গ্রাম বা ২৭৬ গ্রাম। আমাদের মোট প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা৬০-৭০ ভাগ শর্করা হতে গ্রহণ করা দরকার।
কাজ : সামান্য পরিমাণ এরারুট দ্রবণ বা ভাতের মাড় একটি টেস্টটিউবে নাও এবং এর সাথে সামান্য পরিমাণপানি মেশাও। এবার এর ভিতর দুই-তিন ফোঁটা আয়োডিন দ্রবণ মেশাও। কী ঘটে দেখ? দ্রবণটি নীল বর্ণ ধারণ করবে। এ থেকে উক্ত দ্রবণে শর্করা বা শ্বেতসারের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।
অভাবজনিত রোগ
আহারে কম বা বেশি শর্করা গ্রহণ উভয়ই দেহের জন্য ক্ষতিকর। শর্করার অভাবে অপুষ্টি দেখা দেয়। রক্তে শর্করারপরিমাণ কমে গেলে দেহে বিপাক ক্রিয়ার সমস্যার সৃষ্টি হয়। রক্তে শর্করার মাত্রা কমে গেলে হাইপোগ্লাইসমিয়ার লক্ষণদেখা দেয়। যেমনঃ
– ক্ষুধা অনুভব করা
– বমি বমি ভাব
– অতিরিক্ত ঘামানো
– হৃদকম্পন বেড়ে বা কমে যেতে পারে।
খাদ্য ও পুষ্টি
আমিষ বা প্রোটিন
আমিষ আমাদের দেহের গঠন উপাদান। আমিষ কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত। আমিষে ১৬% নাইট্রোজেন থাকে। কখনও কখনও ফসফরাস, লৌহ ও অন্যান্য মৌলিক উপাদানও আমিষে সামান্য পরিমাণে থাকে। কোনো কোনো সময় আমিষে অতি সামান্য পরিমাণ আয়োডিন থাকে। নাইট্রোজেন এবং শেষোক্ত উপাদানগুলোর উপস্থিতির কারণে এর গঠন ও গুরুত্ব অন্যান্য উপাদান থেকে স্বতন্ত্র। কেবলমাত্র আমিষ জাতীয় খাদ্য দেহে নাইট্রোজেন সরবরাহ করতে পারে। তাই পুষ্টি বিজ্ঞানে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। আমিষ পরিপাক হওয়ার পর অ্যামাইনো এসিডে পরিণত হয়।আমিষ হলো অ্যামাইনো এসিডের একটি জটিল যৌগ। পরিপাক প্রক্রিয়া দ্বারা এটি দেহে শোষণ উপযোগীঅ্যামাইনো এসিডে পরিণত হয়। অ্যামাইনো এসিড নাইট্রোজেন দ্বারা গঠিত যৌগ।
এ পর্যন্ত প্রকৃতিজাত দ্রব্যে২২ প্রকার অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমরা বাংলা বা ইংরেজি বর্ণমালাগুলো সাজিয়ে যেমনঅসংখ্য শব্দ গঠন করতে পারি, তেমনি ২২টি অ্যামাইনো এসিড বিভিন্ন সংখ্যায়, বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে মিলিত হয়ে আমিষের উৎপত্তি ঘটায়। এ কারণে মাছ, দুধ, মাংস ইত্যাদি খাবারের স্বাদ, গন্ধ বর্ণের তারতম্য দেখা যায়। দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও নাইট্রোজেনের সমতা রক্ষার জন্য কয়েকটি অ্যামাইনো এসিড অত্যন্ত প্রয়োজন। এগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড বলে। অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনোএসিড দেহে তৈরি হতে পারে না। খাদ্য থেকে এ অ্যামাইনোএসিডগুলো সংগ্রহ করতে হয়। দেহে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডের অভাব বিশেষভাবেক্ষতিকর। খাদ্যে প্রাণীজ আমিষ অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনোএসিডের অভাব ঘটলে নানা রোগ উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- বমি বমি ভাব, মূত্রে জৈব এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নাইট্রোজেনেরভারসাম্য বজায় না থাকা ইত্যাদি।
সব আমিষ দেহে সমান পরিমাণে শোষিত হয় না। আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করার পর এর শতকরা যত ভাগ অন্ত্রথেকে দেহে বিশেষিত হয় তত ভাগকে সেই আমিষের সহজপাচ্যতার গুণক ধরা হয়। সহজপাচ্যতার উপর আমিষেরপুষ্টিমান নির্ভর করে। যে আমিষ শতকরা ১০০ ভাগই দেহে শোষিত হয় এবং দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণে কাজ করেতার সহজপাচ্যতার গুণক ১। এক্ষেত্রে আমিষ গ্রহণ এবং দেহে ধারণের পরিমাণ সমান। সহজ অর্থে বলতে গেলেযতটুকু আমিষ গ্রহণ করা হয় তার সম্পূর্ণটাই দেহে বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণে কাজ করে। আর তা না হলে সহজপাচ্যতারগুণক ১ হতে কম হয়। মায়ের দুধ ও ডিমের আমিষের সহজপাচ্যতার গুণক ১। অন্যান্য সব আমিষেরই সহজপাচ্যতারগুণক ১ হতে কম।
কাজ : সামান্য পরিমাণ আমিষ (ডিমের সাদা অংশ) জাতীয় খাদ্য হামানদিস্তার সাহায্যে পিষে ফেলতে হবে।ভালো করে পিষে ফেলার জন্য সামান্য পরিমাণ পানি মেশানো যেতে পারে। এবার টেস্টটিউবে সামান্য পরিমাণআমিষের দ্রবণ নাও। উক্ত দ্রবণে কয়েক ফোঁটা সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের দ্রবণ এবং কয়েক ফোঁটা কপারসালফেট দ্রবণ মেশাও। এতে উক্ত দ্রবণে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছ কী? আমিষের দ্রবণের সাথে রাসায়নিক দ্রব্যগুলো মিশানোর পর দ্রবণটি বেগুনি রঙ ধারণ করেছে। এভাবে উক্ত দ্রবণেআমিষের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।
আমিষের অভাবজনিত রোগ
খাদ্যে পরিমিত প্রয়োজনীয় জৈব আমিষ বা মিশ্র আমিষ না থাকলে শিশুর দেহে আমিষের অভাবজনিত সমস্যার সৃষ্টিহয়। দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেহে বৃদ্ধি বন্ধ বা স্থগিত থাকলে শিশু পুষ্টিহীনতায় ভোগে।
শিশুদের কোয়াশিয়রকর ও মেরাসমাস রোগ দেখা দেয়।
কোয়াশিয়রকর রোগের লক্ষণ
– শিশুদের খাওয়ায় অরুচি হয়।
– পেশি শীর্ণ ও দুর্বল হতে থাকে, চামড়া, চুলের মসৃণতা ও রং নষ্ট হয়ে যায়।
– ডায়রিয়া রোগ হয়, শরীরে পানি আসে।
– পেট বড় হয়।
উপযুক্ত চিকিৎসার দ্বারা এ রোগ নিরাময় হলেও দেহে মানসিক স্থবিরতা আসে। কোয়াশিয়রকর রোগ মারাত্মক হলেশিশুর মৃত্যু হতে পারে।
খাদ্য ও পুষ্টি
মেরাসমাস রোগের লক্ষণ
– আমিষ ও ক্যালরি উভয়েরই অভাব ঘটে, ফলে দেহের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
– শরীর ক্ষীণ হয়ে অস্থিচর্মসার হয়।
– চামড়া বা ত্বক খসখসে হয়ে ঝুলে পড়ে।
– শরীরের ওজন হ্রাস পায়।
শিশুদের জন্য এরূপ অবস্থা বিপজ্জনক। এছাড়া প্রোটিনের অভাবে বয়স্কদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ওরক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
নতুন শব্দ : সহজপাচ্যতার গুণক, গ্ল্যাকটোজ, অ্যামাইনো এসিড।
স্নেহ পদার্থ
একে শক্তি উৎপাদনকারী উপাদান বলা হয়। স্নেহ পদার্থে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে।কার্বনের দহন ক্ষমতা বেশি থাকায় স্নেহ পদার্থের অণু থেকে বেশি তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। স্নেহ পদার্থ ফ্যাটি এসিড ওগ্লিসারলের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌগ। স্নেহপদার্থ পরিপাক হয়ে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়। ফ্যাটি এসিডও গ্লিসারল ক্ষুদ্রান্ত্রের ভিলাইয়ের ভিতরে অবস্থিত লসিকা নালির মাধ্যমে শোষিত হয়। এই খাদ্যে ২০ প্রকার চর্বিজাতীয় এসিড পাওয়া যায়। চর্বি জাতীয় এসিড দুই প্রকার। যথা-
১. অসম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড ও ২. সম্পৃক্ত চর্বিজাতীয় এসিড। দেহে যকৃতের মধ্যে চর্বি জাতীয় এসিড তৈরি হয়। কিন্তু যকৃতের চর্বি জাতীয় এসিড তৈরির ক্ষমতা অত্যন্ত কম। কিন্তুকিছু কিছু চর্বি জাতীয় এসিড আছে যা দেহের জন্য অত্যাবশ্যক। এগুলো প্রধানত উদ্ভিজ তেলে পাওয়া যায়। খাদ্যে স্নেহ পদার্থের পরিমাণ দ্বারা এর উপকারিতা যাচাই করা যায় না। যে স্নেহ জাতীয় খাদ্যে অসম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিডবেশি থাকে তা বেশি উপকারী। যেমন- সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল, ভুট্টার তেল ইত্যাদি।
এসব তেল দিয়ে তৈরি খাবার উৎকৃষ্টতর স্নেহ জাতীয় খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- মেয়নিজ, সালাদ ড্রেসিং, কাসুন্দি,তেলের আচার ইত্যাদি উৎকৃষ্টতর স্নেহ জাতীয় খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। যে সব খাদ্যে সম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড বেশি থাকেসে সকল খাদ্যগুলোকে স্নেহ বহুল খাদ্য বলা হয়। যেমন- মাংস, মাখন, পনির, ডালডা, চকলেট, বাদাম ইত্যাদি।পুষ্টিবিজ্ঞান মতে দৈনিক মোট শক্তির ২০%-৩০% শক্তি স্নেহ থেকে পাওয়া যায়।
দৈনিক আহার্যে এমন স্নেহযুক্ত খাদ্যঅন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা অত্যাবশ্যকীয় চর্বি জাতীয় এসিড যোগাতে পারে এবং ভিটামিন দ্রবণে সক্ষম হয়।খাদ্যে স্নেহ পদার্থের অভাব ঘটলে দেহে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের অভাবপরিলক্ষিত হয় ফলে ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ দেখা দেয়। যেমন- ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হয়ে দেহের সৌন্দর্য নষ্ট করে, অত্যাবশ্যকীয় চর্বিজাতীয় এসিডের অভাবে শিশুদের একজিমা রোগ হয় ও বয়স্কদেরচর্মরোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়।
কাজ : একটি টেস্টটিউবে কয়েক ফোঁটা সয়াবিন তেল নাও। এর ভেতর সামান্য ইথানল মিশাও। এবার
টেস্টটিউবটিকে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নাও। এবার দ্রবণটিতে সামান্য পানি মিশিয়ে টেস্টটিউবটি আবার ঝাঁকিয়েনাও। কী ঘটে লক্ষ কর। তেলের দ্রবণটি ঘোলাটে বর্ণ ধারণ করবে।
এভাবে সরিষা, নারকেল ও তিলের তেলের সাহায্যে উক্ত পরীক্ষাটি কর এবং কী ঘটে তা বর্ণনা কর।
খাদ্যের ক্যালরি ও কর্মশক্তি
শর্করা, আমিষ ও স্নেহ পদার্থ খাদ্যের এ তিনটি উপাদান থেকেদেহে তাপ উৎপন্ন হয়। পুষ্টি উপাদান ও তার পরিমাণ জানাজন্য শর্করা, আমিষ ও চর্বি ক্যালরি বের করতে হয়। এ ক্ষেত্রেভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানির ক্যালরিমূল্য শূন্য ধরে হিসেবকরতে হবে। এ তাপ আমাদের দেহে কাজ করার শক্তি যোগায়।
আমাদের দেহের ভিতর খাদ্য পরিপাক, শ্বসন, রক্তসংবহন ইত্যাদি কার্যক্রম বিপাক ক্রিয়ার অন্তর্গত। বিপাক ক্রিয়া চালানোরজন্য যে শক্তি প্রয়োজন তাকে মৌলবিপাক বলে। আবার শারীরিক পরিশ্রমেও আমাদের শক্তি ব্যয় হয়। আমরা খাবার থেকেশক্তি পাই।
আমাদের দেহে ১ গ্রাম শর্করা থেকে ৪ ক্যালরি ১ গ্রাম আমিষ থেকে ৪ ক্যালরি ১ গ্রাম চর্বি থেকে ৯ ক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়। খাদ্য থেকে দেহের ভিতর যে তাপ উৎপন্ন হয় তা আমরা ক্যালরিতে প্রকাশ করি। ১০০০ ক্যালরিতে ১ কিলোক্যালরি।খাদ্যে তাপশক্তি মাপের একক হলো কিলোক্যালরি। দেহের শক্তির চাহিদাও কিলোক্যালরিতে নির্ণয় করা হয়। আমার, তোমার, তোমার ছোট ভাই, তোমার বাবার দেহের ক্যালরি চাহিদা এক রকম নয়। আমাদের দেহে দুই ভাবেশক্তি ব্যয় হয় যথা- ১. দেহের অভ্যন্তরীণ কাজে অর্থাৎ মৌলবিপাকে এবং ২. পরিশ্রমের কাজে। প্রতিদিন কার কতক্যালরি বা তাপ শক্তির প্রয়োজন তা নির্ভর করে প্রধানত বয়স, দৈহিক উচ্চতা এবং দৈহিক ওজনের উপর। এছাড়াবিভিন্ন পেশা এবং স্ত্রী-পুরুষ ভেদে দৈনিক ক্যালরি চাহিদা কম বা বেশি হয়ে থাকে।
খাদ্য ও পুষ্টি
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করেছেন যে, খাদ্যে শর্করা, আমিষ, স্নেহ পদার্থ, খনিজ লবণ ছাড়াআরও কতকগুলো সূক্ষ্ম উপাদানের প্রয়োজন। এর অভাবে শরীর নানা রোগে (যেমন- রাতকানা, বেরিবেরি, স্কার্ভিইত্যাদি) আক্রান্ত হয়। ভিটামিন বলতে আমরা খাদ্যের ঐ সব জৈব রাসায়নিক পদার্থকে বুঝি যা খাদ্যে অত্যন্ত সামান্যপরিমাণে উপস্থিত থাকে। ভিটামিনসমূহ প্রত্যক্ষভাবে দেহ গঠনে অংশগ্রহণ না করলেও এদের অভাবে দেহেরক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন বা তাপশক্তি উৎপাদন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্রিয়াগুলো সুসম্পন্ন হতে পারে না।
ভিটামিনের প্রকারভেদ : দ্রবণীয়তার গুণ অনুসারে ভিটামিনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. স্নেহ জাতীয় পদার্থে দ্রবণীয় ভিটামিন, যেমন- এ, ডি, ই, এবং কে।
২. পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন, যেমন- ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স এবং সি।
ভিটামিনের উৎস : গাছের সবুজ পাতা, কচি ডগা, হলুদ ও সবুজ বর্ণের সবজি, ফল ও বীজ ইত্যাদি অংশে ভিটামিন থাকে।
ভিটামিন এ
উৎস : মাছের তেল ও প্রাণীজ স্নেহেপ্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। ক্যারোটিন সমৃদ্ধ শাক-সবজি যেমনলালশাক,পুঁইশাক, পালংশাক, টমেটো, গাজর, বীট ও মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের ফল যেমন- পেঁপে, আমকাঁঠালে ভিটামিন ‘এ’ থাকে। মলা ও ঢেলা মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ থাকে।
দেহে ভিটামিনের কাজ হলো- দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখা, ত্বক ও শ্লেষাঝিলিকে সুস্থ রাখা এবং দেহকে বিভিন্ন সংক্রামকরোগের হাত থেকে রক্ষা করা, খাদ্যদ্রব্য পরিপাক ও ক্ষুধার উদ্রেক করা, রক্তে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা ও দেহেরপুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
অভাবজনিত রোগ
১. রাতকানা : এ রোগের লক্ষণ স্বল্প আলোতে বিশেষ করে রাতে আবছা আলোতে দেখতে না পাওয়া। শিশুরা এ রোগেবেশি আক্রান্ত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে চোখ সম্পূর্ণরূপে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ রোগে আক্রান্তশিশুকে সবুজ শাকসবজি ও রঙিন ফলমূল খাওয়ানো উচিত। ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সাহায্যকরে। আমাদের দেশে টিকা দিবসে বিভিন্ন টিকা কেন্দ্রে শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়।
২. জেরপথালমিয়া : ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব ঘটলে চোখের কর্নিয়ার আচ্ছাদন ক্ষতিগ্রস্তহয়। কর্নিয়ার উপর শুষ্ক স্তর পড়ে। তখন চোখ শুকিয়ে যায় এবং পানি পড়া বন্ধ হয়ে যায়। চোখে আলো সহ্য হয় না, চোখে পুঁজ জমে এবংচোখের পাতা ফুলে যায়। এ অবস্থায় উপযুক্ত চিকিৎসা করালে এ রোগ থেকে উপশম পাওয়া যেতে পারে। তবে সময় মতো চিকিৎসা না হলেশিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব ঘটলে দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সর্দি, কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি রোগ হতেপারে।
ভিটামিন বি–কমপ্লেক্স
ভিটামিন বি-কমপ্লেক্সগোষ্ঠীর কাজ হলো বিশেষ বিশেষ উৎসেচকের অংশ হিসেবে আমিষ, শর্করা ও স্নেহ পদার্থকেবিশ্লিষ্ট করা এবং এদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে মুক্ত হতে সাহায্য করা। ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) : এর প্রধান কাজ হলো শর্করা বিপাকে অংশগ্রহণ করে শক্তিমুক্ত করা। তাছাড়া স্বাভাবিক ক্ষুধাবজায় রাখতে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখতে সহায়তা করা।
ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাবিন) : এটা অ্যামাইনো এসিড, ফ্যাটি এসিড ও কার্বহাইড্রেডের বিপাকে অংশ নিয়ে শক্তিউৎপাদনে সাহায্য করা।
ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন) : এটা শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে।
ভিটামিন বি১২ (সায়ানোকোবালামিন) : এটা লোহিত রক্তকণিকা বৃদ্ধি ও উৎপাদনে সহায়তা করে। শ্বেত রক্তকণিকা ওঅনুচক্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
খাদ্য ও পুষ্টি
ভিটামিন ‘সি’
দেহের জন্য ভিটামিন ‘সি’ অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। এ ভিটামিন পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং সামান্য তাপেই নষ্ট হয়েযায়। দেহে জমা থাকে না তাই প্রতিদিন ভিটামিন ‘সি’ খাওয়া দরকার। টক জাতীয় ফল আমলকি, আনারস, পেয়ারা,কমলালেবু, লেবু, আমড়া ইত্যাদি ফলে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ থাকে। সবুজ শাকসবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো,লেটুসপাতা থেকে আমরা ভিটামিন ‘সি’ পাই। পাকা ফল অপেক্ষা কাঁচা সবজি ও ফলে এ ভিটামিন বেশি থাকে।ভিটামিন ‘সি’ পেশি, দাঁত মজবুত করে, ক্ষত নিরাময় ও চর্মরোগ রোধে সহায়তা করে, কণ্ঠনালি ও নাকেসংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
অভাবজনিত রোগ
প্রাপ্ত বয়স্কদের দেহে ভিটামিন ‘সি’-এর অভাব প্রকট হলে নিুলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয় :
– হাঁড়ের গঠন শক্ত ও মজবুত হতে পারে না।
– হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়।
– ত্বক খসখসে হয়, চুলকায়, ত্বকে ঘা হলে সহজে তা শুকাতে চায় না।
স্কার্ভি
– দাঁতের মাড়ি ফুলে নরম হয়ে যায়।
– দাঁতের গোড়া আলগা হয়ে যায় এবং গোড়া থেকে রক্ত পড়ে।
– দাঁতের এনামেল উঠে যায় এতে অকালে দাঁত পড়ে যেতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের এ রোগ বেশি হয়।
– গ্রন্থি ফুলে যায় এবং মুখে ব্যথা হয়।
– রক্তক্ষরণ সহজে বন্ধ হয় না, ঘা শুকাতে দেরি হয়।
– অন্যান্য রোগ বিশেষ করে সর্দি, কাশি খুব সহজে আক্রমণ করে।
প্রতিকার
এ অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
প্রতিরোধ
কোলের শিশুকে মায়ের দুধের সঙ্গে অন্যান্য পরিপূরক খাদ্য যেমন ফলের রস, সবজির স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে।
ভিটামিন ‘ডি’
ভোজ্য তেল, দুগ্ধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য, বিভিন্ন মাছের তেল, ডিমের কুসুম, মাখন, ঘি, চর্বি এবং ইলিশ মাছে পর্যাপ্তপরিমাণে ভিটামিন ‘ডি’ পাওয়া যায়।
কাজ
– অস্থি ও দাঁতের কাঠামো গঠন।
– অন্ত্রে ক্যালসিয়াম বিশোষণ বাড়ায়।
– রক্ত প্রবাহে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
খাদ্য ও পুষ্টি
অভাব জনিত রোগ
ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাবে লোহার বিশোষণ, সঞ্চয় ও হিমোগ্লোবিন তৈরিতে বিঘ্ন ঘটে।
রিকেটস
রিকেটস রোগের লক্ষণ
– ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুদের হাড় নরম হয়ে যায় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
– পায়ের হাড় ধনুকের মতো বেঁকে যায় এবং দেহের চাপে অন্যান্য হাড়গুলোও বেঁকে যায়।
– হাত-পায়ের অস্থিসন্ধি বা গিট ফুলে যায়।
– বুকের হাড় বা পাঁজরের হাড় বেঁকে যায়।
প্রতিকার
এ অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
প্রতিরোধ
শিশুকে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। সূর্য রশ্মি থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। তাই শিশুকেকিছুক্ষণের জন্য রৌদ্রে খেলাধুলা করতে দেওয়া উচিত।
অস্টম্যালেশিয়া
বয়স্কদের রিকেটস অস্টম্যালেশিয়া নামে পরিচিত। এই রোগের লক্ষণগুলো নিুরূপ –
– ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাবে ক্যালসিয়াম শোষণে বিঘ্ন ঘটে।
– ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের সঞ্চয় কমতে থাকে।
– থাইরয়েড গ্রন্থির কাজের পরিবর্তন ঘটে।
– অস্থি দুর্বল হয়ে অস্থির কাঠিন্য কমে যায় এবং হালকা আঘাতেই অস্থি ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশিথাকে।
প্রতিকার
উপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। উপযুক্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে উক্ত উপাদানগুলোর জন্য ঔষধ সেবন করা একান্ত জরুরী।
প্রতিরোধ
– শিশুকাল থেকেই ভিটামিন ‘ডি’ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া সুনিশ্চিত করতে হবে।
– শিশুদেরকে কিছুক্ষণের জন্য রৌদ্রে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভিটামিন ‘ই’
ভোজ্যতেল ভিটামিন ‘ই’ এর সবচেয়ে ভালো উৎস। শস্যদানা, যকৃত, মাছ-মাংসের চর্বিতে ভিটামিন ‘ই’ পাওয়া যায়।
কাজ
– ভিটামিন ‘ই’ কোষ গঠনে সহায়তা করে।
– শরীরের কিছু ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
– খুব কম ক্ষেত্রে ভিটামিন ‘ই’ এর অভাব ঘটে এবং এর অভাব জনিত লক্ষণও কম।
খাদ্য ও পুষ্টি
ভিটামিন ‘কে’
সবুজ রঙের শাকসবজি, লেটুসপাতা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ডিমের কুসুম, সয়াবিন তেল এবং যকৃতে ভিটামিন ‘কে’পাওয়া যায়।
কাজ
– দেহে ভিটামিন ‘কে’ প্রথ্রোম্বিন নামক প্রোটিন তৈরি করে।
– প্রথ্রোম্বিন রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
অভাব জনিত সমস্যা
যকৃত থেকে পিত্তরস নিঃসৃত হয়। পিত্তরস নিঃসরণে অসুবিধা হলে ভিটামিন কে-এর শোষণ কমে যায়। ভিটামিন ‘কে’-এর অভাবে ত্বকের নিচে ও দেহাভ্যন্তরে যে রক্ত ক্ষরণ হয় তা বন্ধ করার ব্যবস্থা না নিলে রোগী মারা যেতে পারে। এভিটামিনের অভাবে অপারেশনের রোগীর রক্তক্ষরণ সহজে বন্ধ হতে চায় না। এতে রোগীর জীবন নাশের আশংকা বেশিথাকে।
ভাত এবং তরকারীর সাথে আমরা প্রত্যহ যে খাবার লবণ খাই, এছাড়াও আরও অনেক প্রকার লবণ আছে যাআমাদের দেহের জন্য অতীব প্রয়োজন। খাদ্যে খনিজ লবণ আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থের মতো দেহে তাপ উৎপন্ন করে না। কিন্তু দেহকোষ ও দেহ তরলের জন্য খনিজ লবণ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, আয়োডিন, লৌহ, সালফার ইত্যাদি লবণ জাতীয় দ্রব্য খাদ্যের সাথে দেহে প্রবেশকরে ও দেহ গঠনে সাহায্য করে। এসব উপাদান দেহে মৌলিক উপাদান হিসেবে থাকে না, অন্য পদার্থের সঙ্গেজৈব ও অজৈব যৌগরূপে থাকে। প্রধানত দুই ভাবে খনিজ লবণ দেহে কাজ করে। যথা- দেহ গঠন উপাদান রূপে ওদেহ অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। মাংস, ডিম, দুধ, সবুজ শাকসবজি এবং ফল খনিজ লবণের প্রধান উৎস।
খনিজ লবণ দেহ গঠন ও দেহের অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, অস্থি, দাঁত, এনজাইম ও হরমোন গঠনের জন্যখনিজ লবণ অপরিহার্য উপাদান, স্নায়ু উদ্দীপনা ও পেশি সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করে, দেহের জলীয় অংশে সমতা রক্ষা করেও বিভিন্ন এনজাইম সক্রিয় রাখে।
মানবদেহে খনিজ লবণের প্রয়োজনীতা ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড় গঠনে, রক্ত জমাট বাঁধতে, স্নায়ু ব্যবস্থায় সুষ্ঠু কাজ সম্পাদনে সহায়তা করে। ফসফরাসদাঁত ও হাড় গঠন, ফসফোলিপিড তৈরি করে। লৌহ রক্তের লোহিত রক্তকণিকা গঠন, উৎসেচক বা এনজাইমেরকার্যকারিতায় সহায়তা করে। আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ ও বিপাকের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সহায়তাকরে। দেহের অধিকাংশ কোষ ও দেহরসের জন্য সোডিয়াম প্রয়োজন। পেশি সংকোচনে পটাশিয়াম গুরুত্বপূর্ণভূমিকা পালন করে।
অভাবজনিত রোগ
রিকেটস : দেহে ভিটামিন ‘ডি’-এর সঙ্গে ক্যালসিয়াম শোষিত হয়। এই ভিটামিনের অভাবে রিকেটস রোগ হয়।ভিটামিন অংশে এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
গলগন্ড : গলগন্ড রোগকে ঘ্যাগ বলে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর, জামালপুর ওময়মনসিংহে এ রোগের প্রকোপ বেশি। যখন আমাদের রক্তে কোনো কারণে আয়োডিনের অভাব ঘটে তখন গলায়অবস্থিত থাইরয়েডগ্রন্থি ক্রমশ আকারে বড় হতে থাকে। গলাটা ফুলে যায়। একে গলগন্ড বা ঘ্যাগ বলে।
এ রোগেলক্ষণগুলো নিম্নরূপ :
– থাইরয়েডগ্রন্থি ফুলে যায়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
– শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শব্দ হয়।
– গলার আওয়াজ ফ্যাঁসফেসে হয়ে যায়।
– গলায় অস্বস্তিবোধ, খাবার গিলতে কষ্ট হয়।
– আক্রান্ত ব্যক্তি অবসাদগ্রস্ত ও দুর্বলবোধ করে।
প্রতিকার
রোগের প্রাথমিক অবস্থায় আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া, সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল ও সামুদ্রিক শৈবাল ইত্যাদি খাওয়ারঅভ্যাস গড়ে তোলা। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
খাদ্য ও পুষ্টি
ক্রোটিনিজম
সাধারণত আয়োডিনের অভাবে শিশুদের এ রোগ হয়। এই রোগে আক্রান্ত শিশুর দেহে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয় তাহলঃ
– দেহের বর্ধন মন্থর হয়।
– পুরু ত্বক, মুখমণ্ডলের পরিবর্তন দেখা দেয়।
– পুরু ঠোঁট, বড় জিহ্বা, মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
প্রতিকার
যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা করা হলে শিশুদের দৈহিক অসুবিধাগুলো ও স্বাভাবিক বর্ধন ঠিক রাখা যায়।
প্রতিরোধ
খাবারে আয়োডিনযুক্ত লবণ দিয়ে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
রক্তাল্পতা বা এ্যানিমিয়া
লোহা, লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিনের গঠন উপাদান। শিশু ও সন্তান সম্ভবা মায়ের খাদ্যে লোহার ঘাটতির জন্যরক্তাল্পতা দেখা যায়। সাধারণত শিশুদের পেটে কৃমি হলে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। এর লক্ষণগুলো হলো –
– দুর্বলতাবোধ, মাথা, গা ঝিমঝিম করা।
– বুক ধড়ফড় করা।
– মাথা ঘোরানো, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা।
– ওজন হ্রাস ও খাওয়ায় অরুচি দেখা দেয়।
প্রতিকার
লৌহ সমৃদ্ধ শাকসবজি, ফল, মাংস, ডিমের কুসুম, যকৃত ও বৃক্ক ইত্যাদি বেশি করে খাওয়া। প্রয়োজনে ডাক্তারেরপরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করা। রোগ কঠিন আকার ধারণ করলে হৃৎপিণ্ডের দ্রুত রক্ত সঞ্চালন ও হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়েমৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পানি
পানি জীবন ধারণের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। প্রাণী দেহের ৬০-৭০ ভাগই পানি। দেহ গঠনে পানিরপ্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। এ পানি অস্থি, মাংস, ত্বক, নখ, দাঁত ইত্যাদি কোষের ভিতরে ও বাইরে থাকে। প্রায় সবখাদ্যেই কম-বেশি পানি থাকে। তবে আমরা আলাদাভাবে পানি পান করে দেহের চাহিদা মেটাই। দেহ গঠন ছাড়াও পানি দেহের সব অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। পানি ছাড়া দেহের ভিতরে কোনো রাসায়নিক ক্রিয়াহতে পারে না। পানি দেহে দ্রাবক রূপে কাজ করে। বিভিন্ন খনিজ লবণ পানিতে দ্রবীভূত থাকে। পানিতে দ্রবণীয় অবস্থায়খাদ্যের পরিপাক ক্রিয়া চলে। আবার পানিতে দ্রবীভূত থেকেই খাদ্য উপাদান দেহে শোষিত হয়।
কাজ
– পানির জন্যই রক্ত সঞ্চালন ও তাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।
– পানি দেহ থেকে দূষিত পদার্থ অপসারণ করে। যেমন- মূত্র ও ঘাম।
কলেরা ও উদরাময় রোগে মলের সঙ্গে বা বমির সঙ্গে দেহ থেকে হঠাৎ বেশ কিছু পানি বের হয়ে অসুবিধা ঘটায়।আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুস থেকে দৈনিক প্রায় ৪৫০ মিলি. পানি বাইরে চলে যায়। কলেরা বা উদরাময় রোগহলে রোগীকে স্যালাইন বা লবণ পানির শরবত খাওয়াতে হবে। এটা কলেরা বা উদরাময়ের সবচেয়ে সহজ চিকিৎসা।এছাড়া আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র কর্তৃক তৈরি খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া যায়। ওটা পানিতে গুলেরোগীকে খাওয়াতে হয়। সম্প্রতি শস্য স্যালাইন নামক আর একটি খাওয়ার স্যালাইন উদ্ভাবিত হয়েছে। ১ লিটার পানি,৫০ গ্রাম চালের গুঁড়া ও এক চিমটি লবণ মিলিয়ে এ স্যালাইন তৈরি করা হয়।
কাজ তোমরা আগের শ্রেণিতে খাবার স্যালাইন বানাতে শিখেছ। এবার তোমরা পুনরায় খাবার স্যালাইন তৈরিকর। স্যালাইন তৈরির সময় তোমরা কী কী সাবধানতা অবলম্বন করবে তা লিপিবদ্ধ করবে।
শুষ্কতা
কোনো কারণে দেহে পানির পরিমাণ কমে গেলে কোষগুলোতে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়। কোষের পানি কমে গেলেঅতিরিক্ত পিপাসা হয়, রক্তের চাপ কমে যায়, রক্ত সঞ্চালনে অসুবিধা হয়, বিপাক বিক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। পানির অভাবেদেহের ওজন কমে যায় এবং পেশি ও স্নায়ুকোষ দুর্বল হয়ে পড়ে। দেহে পানির পরিমাণ ২০ শতাংশের নিচে নেমে গেলেদেহের স্বাভাবিক কাজে বিঘড়ব ঘটে, ফলে রোগী বেহুশ হয়ে পড়ে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
রাফেজ বা আঁশযুক্ত তন্তু
শস্যদানা, ফলমূল, সবজির অপাচ্য অংশকে রাফেজ বলে। দেহের ভিতর রাফেজের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। রাফেজ কোনোপুষ্টি উপাদান নয়। তবে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাফেজ পৌষ্টিক নালির ভিতর দিয়ে সরাসরিস্থানান্তরিত হয়। ফল ও সবজির রাফেজ, সেলুলোজ নির্মিত কোষপ্রাচীর। আঁশযুক্ত খাবার থেকে রাফেজ পাওয়া যায়।
খাদ্য ও পুষ্টি
খাদ্য নির্বাচন
যে সমস্ত খাদ্যবস্তু দেহের ক্যালরি চাহিদা পূরণ করে, টিস্যু কোষের বৃদ্ধি ও গঠন বজায় রাখে এবং দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলীকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাকে সুষম খাদ্য বলে। অর্থাৎ সুষম খাদ্য বলতে বুঝায় ৬টিউপাদান বিশিষ্ট পরিমাণ মতো খাবার যা ব্যক্তিবিশেষের দেহের চাহিদা মেটায়। বয়স, লিঙ্গভেদ, দৈহিক অবস্থা, শ্রমের পরিমাণ হিসেবে পুষ্টির প্রয়োজনীয় উপাদনগুলো উপযুক্ত পরিমাণে সুষমখাদ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকে। যে শর্ত পালনে খাবার সুষম হয় সেগুলো হলো-
১. প্রতিবেলার খাবারে আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থ এই তিনটি শ্রেণির খাবার অন্তর্ভুক্ত করে খাদ্যের ছয়টি উপাদানেরঅন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিত করা।
২. প্রত্যেক শ্রেণির খাদ্য বয়স, লিঙ্গ ও জীবিকা অনুযায়ী সরবরাহ করা।
৩. দৈনিক ক্যালরি ৬০-৭০% শর্করা, ১০% আমিষ ও ৩০-৪০% স্নেহ জাতীয় পদার্থ থেকে গ্রহণ করা।
সুষম খাদ্য তালিকা
কতকগুলো নিয়ম মেনে একটি সুষম খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে। যথা-
১. প্রথমত খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানগুলো ব্যক্তিবিশেষের বয়স, কর্ম ও শারীরিক অবস্থাভেদে যে বিভিন্ন ধরনের হয়সেদিকে লক্ষ রেখে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা।
২. দৈহিক প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্যের তাপমূল্য বা ক্যালরি তাপ শক্তির পরিমাণ নিশ্চিতকরণ।
৩. খাদ্যে দেহ গঠনের ও ক্ষয়পূরণের উপযোগী আমিষ সরবরাহ করা।
৪. খাদ্যে যথোপযুক্ত ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানির উপস্থিতি।
৫. বিভিন্ন খাদ্যের পুষ্টিমান ও খাদ্যের শ্রেণিবিভাগ সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন। প্রথমে খাদ্যের মূল বিভাগগুলো থেকে খাদ্য বাছাইকরা। খাদ্য বাছাইয়ে বৈচিত্র্য থাকা।
৬. খাদ্য তালিকা প্রস্তুতির সময় খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতনথাকা।
৭. ব্যক্তি ও পরিবারের আর্থিক সঙ্গতির দিক ভেবে খাদ্য তালিকাপ্রস্তুত করা।
৮. ঋতুও আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা।
খাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টিখাদ্য ও পুষ্টি