ভুট্টা চাষ অধিক লাভ ধান থেকে বলছে নীলফামারীর কৃষকেরা
ধান ছেড়ে ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন নীলফামারীর কৃষকরা।
নীলফামারীর কৃষকরা লাভজনক ও পুষ্টি সমৃদ্ধ ফসল ভুট্টা চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। ভুট্টা এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনজীবিকা। ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে এবং ভুট্টা গাছ ও সবুজপাতা উন্নতমানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া জ্বালানি হিসেবে ভুট্টার গাছের রয়েছে আলাদা কদর।
এক সময় চরাঞ্চলের মানুষ না খেয়ে কষ্টে জীবনযাপন করত। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে চর এলাকার চেহারা বদলে গেছে। বালুচরে ভুট্টা চাষ করে পাল্টে গেছে তাদের এখানকার মানুষের জীবন। গ্রামগুলোতে খড়ের ঘরের পরিবর্তে উঠেছে আধাপাকা ঘর। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না তাদের।
তিস্তা নদীর বুকে জেগে উঠেছে একাধিক চর। সেই চরে চলছে নানা জাতের ফসলের চাষাবাদ। কম সময়ে ও ভূগর্ভস্ত পানি কম ব্যবহার করতে রবিশস্য আবাদের জন্য কৃষকরা ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন। তিস্তার চরাঞ্চলে এবছর আবহাওয়া অনুকূল ও ভুট্টায় পোকার আক্রমণ না থাকায় কৃষকরা বাম্পার ফলনের আশা করছেন।
ভুট্টা চাষে প্রতি বিঘায় প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘায় ভুট্টার ফলন আসে ৩৫-৪০ মণ। বাজারে নতুন ভুট্টার মণ ৬০০-৭০০ টাকা। নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ডিমলায় দুই হাজার ৯৪৫ হেক্টর ও জলঢাকায় ৩২৮ হেক্টর জমি চর বেষ্টিত।
ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী, খালিশা চাপানী, টেপাখড়িবাড়ী, পূর্ব ছাতনাই, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী ও শোলমারী ইউনিয়নে তিস্তার ছোট-বড় প্রায় ২৩টি জেগে ওঠা চরে ভুট্টার চাষ হচ্ছে।
জেলায় গতবছর ২৩ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। চলতি বছর ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ আরও প্রায় দুই হাজার হেক্টর বেড়েছে। প্রতিবছর তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এবছর ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন।
সরেজমিনে চরগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহ। কৃষকরা কাজে ব্যস্ত। সবুজপাতায় স্বপ্ন বুনছেন তারা। ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও গাছে ফুল আসা শুরু হয়েছে। কোথাও তরতাজা হয়ে গাছ বেরিয়ে আসছে। বোরো ধানের আবাদে খরচ বেশি হওয়ায় ভুট্টার চাষে বেশি আগ্রহ চরাঞ্চলের কৃষকদের।
ঝড়সিংহেশ্বর গ্রামের কৃষক রশিদুলের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বোরো ধানের চাইতে ভুট্টায় লাভ বেশি এজন্য আমরা ভুট্টা চাষ করি। ভুট্টায় প্রতি বিঘায় খরচ হয় ৯-১০ হাজার টাকা আর ৪০-৩৫ মণ ভুট্টা পাই। বর্তমানে ভুট্টার অবস্থা খুব ভালো, যদি ভালো দাম পাই তাহলে আশা করছি লাভবান হবো।
একই এলাকার কৃষক সলেমান আলী বলেন, আমাদের এই চর এলাকায় একসময় বোরো ধান আবাদ করতাম। ধানে রোগবালাই অনেক তাই বর্তমানে বোরো ধান বাদ দিয়ে ভুট্টা চাষ করছি। এবার চার বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করছি। খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। যদি ন্যায্য মূল্য পাই তাহলে আমার আশা এক থেকে দেড় লাখ টাকা আমি ভুট্টা বিক্রি করতে পারবো। ধানে এমন লাভ হয় না।
তিনি আরও বলেন, পূর্ব ছাতনাই খগার চর এলাকার কৃষক রওশন বলেন, আমরা এক ফসলের উপর নির্ভরশীল। আর এই ফসল বিক্রি করেই চলে আমাদের জীবন। তাই অন্য ফসল আবাদ বাদ দিয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ ভুট্টার আবাদ করেই আমাদের জীবন চলে। গতবার ৪ বিঘায় আবাদ করেছিলাম এবার ৫ বিঘার মতো জমিতে ভুট্টার আবাদ করছি।
আগে এই জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হতো তাতে খরচ অনেক বেশি পড়ে যেতো। ধানে প্রত্যেক বছর আমরা ক্ষতির মুখোমুখি হই, কেননা হঠাৎ করে নদীর পানি বেড়ে গেলে আমাদের ধান নষ্ট হয়ে যায়। এর কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বোরো ধানের আবাদ করবো না এখানে আমরা ভুট্টার আবাদ করবো। এখন পর্যন্ত আমার ভুট্টা ক্ষেখেতের কোনো ধরনের রোগবালাই পোকামাকড় আক্রমণ করেনি।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চরাঞ্চলের মানুষ এক সময় ধান আবাদ করতো এখন তারা ভুট্টার আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। কারণ হলো, ভুট্টার আবাদে কৃষকরা সাশ্রয় পাচ্ছেন। ধান আবাদ করলে চরের মধ্যে পানির বেশি প্রয়োজন খরচ বেশি হত। কিন্তু ভুট্টায় সে খরচটা হচ্ছে না আবার কৃষকরা লাভবান বেশি হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, পুষ্টি সমৃদ্ধ ভুট্টা লাভজনক ফসল হওয়াতে কৃষকেরা এ আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন। কৃষি বিভাগ তাদের নানানভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। মাঠকর্মীরা সার্বক্ষণিক তাদের পাশে রয়েছে।
বিশেষ করে তিস্তার চরাঞ্চলের কৃষকেরা ভুট্টা আবাদে অনেক বেশি উৎসাহী। ভুট্টা এখন মানুষ, গরু, মহিষ, ছাগল, মাছ, হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। দিনে দিনে বাড়ছে ভুট্টার আবাদ। এই আবাদে লাভ বেশি থাকায় কৃষকরা এখন ভুট্টা আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।ভুট্টা চাষ অধিক লাভ ধান থেকে বলছে নীলফামারীর কৃষকেরা।